বাচ্চাদের স্কুল পলায়নের কারণ

বাচ্চাদের স্কুল পলায়নের কতগুলো বিশেষ কারণ-জেনে নিন

স্কুল পলায়ন কি?

স্কুল পলায়ন একটি সাধারণ সমস্যামূলক আচরণ। শিশুর মৌলিক চাহিদার অতৃপ্তি থেকে এই সমস্যামূলক আচরণের উদ্ভব হয়।

প্রায়ই দেখা যায় যে বিভিন্ন শিশু বাড়ি থেকে বইখাতা নিয়ে বের হয়।কিন্তু বিদ্যালয়ে না গিয়ে বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা দেয়, সিনেমা দেখে বা বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে।

আবার এমনও দেখা যায় যে, শিশু বিদ্যালয়ে গিয়ে ২/১ ঘন্টা ক্লাস করে কিছু বন্ধুদের উসকে দেয়।

এমনকি তাদের নিয়ে বেরিয়ে যায় এবং বিভিন্ন ধরনের দুঃসাহসিক অভিযান, অসামাজিক কার্যকলাপ ইত্যাদির সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে।

এ ধরনের ছেলেমেয়েরা স্কুল ছুটির পর আবার নির্ধারিত সময়ে সুবােধ বালকের মতাে ঘরে ফেরে।

স্কুল পলায়নের কারণ (Causes of Truancy):

স্কুল পলায়নের কারণগুলােকে প্রধানত ৪টি ভাগে ভাগ করে আলােচনা করা যেতে পারে। যেমন:

১. বংশগত কারণ

২. পরিবেশগত কারণ

৩. সামাজিক কারণ ও

৪. মনােবৈজ্ঞানিক কারণ।

১. বংশগত কারণ:

বর্তমানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, শিশু অপরাধী হয়ে না জন্মালেও জনসময়ে তার মধ্যে এমন কিছু প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য থাকে যা তাকে অপরাধ সৃষ্টিতে ইন্ধন যােগায়।

আমরা আগেই উল্লেখ করেছি স্কুল পলায়ন একটি সাধারণ সমস্যামূলক অপরাধ যা পরবর্তীতে অপরাধমূলক আচরণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। নিম্নলিখিত বংশগত কারণগুলি স্কুলে পলায়নের পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে।

ক. জন্মসূত্রে প্রাপ্ত রােগ-ব্যাধি:

জন্মসূত্রে অনেক ব্যাধি শিশুর মধ্যে সঞ্চালিত হয়ে থাকে। যেমন- হাঁপানি, এমএ, মৃগী ইত্যাদি। এইসব রােগে আক্রান্ত শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্যের সাথে সাথে মানসিক স্বাস্থ্যও ক্ষুন্ন হয়। ফলে তাদের মেজাজ খিটখিটে হয় ও বদরাগী হয়।
স্বাভাবিকভাবেই সহপাঠী ও বিদ্যালয় পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানাে তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে।

খ. দৈহিক কাঠামাে বা গঠন:

জন্মসূত্রে প্রাপ্ত দৈহিক কাঠামাে বা গঠনের উপর কারো হাত নাই। কেউ কদাকার, কেউ বেঁটে, কেউ বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মায়। শিশুর গঠনিক ত্রুটি ও বিকলাঙ্গতা তার মনে দারুণ ক্ষোভ, হতাশা ও হীনমন্যতার সৃষ্টি করে।
শারীরিক ত্রুটির জন্য সে অন্তর্মুখী হয়, নিজেকে একান্তে গুটিয়ে রাখতে চায়, অন্যের সাথে মেলামেশা করতে সংকোচবােধ করে এবং সামাজিক অভিযােজনে ব্যর্থ হয়।
এই ব্যর্থতার কারণে সে বিদ্যালয় থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।

গ. ক্ষীণবুদ্ধিমত্তা:

ক্ষীণবুদ্ধিসম্পন্ন ছেলেমেয়েদের ভালমন্দ, ন্যায়-অন্যায় সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা থাকে না। তাই দুষ্ট বন্ধুদের প্ররােচনায় তারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে এবং স্কুল থেকে পালিয়ে গিয়ে ঐসব কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে।

২. পরিবেশগত কারণ:

অধিকাংশ মনােবিজ্ঞানী স্কুল পলায়নের মতাে সমস্যামূলক আচরণের পেছনে পরিবেশগত কারণকে দায়ী করেন। পরিবেশেগত কারণকে আবার দুইভাগে ভাগ করা যায়-
  • গৃহ অথবা পারিবারিক পরিবেশ জনিত কারণ ও
  • বিদ্যালয় পরিবেশ জনিত কারণ।
  • গৃহ অথবা পারিবারিক পরিবেশ জনিত কারণ:

গৃহে যদি শিশু স্নেহ ভালবাসা না পায় তবে সে নিরাপত্তাহীনতায় ভােগে। এই নিরাপত্তাহীনতা তার মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে। পারিবারিক অভিযােজনের ব্যর্থতা থেকে তার মধ্যে বিভিন্ন সমস্যামূলক আচরণ দেখা যায় এবং এসব আচরণের মধ্যে স্কুল পলায়ন অন্যতম।

ক. পিতামাতার অবহেলা ও প্রত্যাখ্যান:

পিতামাতা শিশুর প্রতি যত্নশীল না হলে, শিশুর প্রতি খেয়াল না রাখলে, শিশুকে অবহেলা করলে শিশুর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এতে শিশু পিতামাতার প্রতি ক্ষুব্ধ ও রুষ্ট হয়।

শিশুর এই ক্ষোভ, অসন্তোষ ও দুঃখ বিশৃঙ্খল আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়।

খ. অতিরিক্ত আদর ও অতিরিক্ত শাসন:

অতিরিক্ত আদর ও শাসনের মধ্যে যেসব শিশু প্রতিপালিত হয় তারা একদিকে যেমন খেয়াল খুশি অনুযায়ী কাজ করতে চায়, তেমনি পরনির্ভরশীল হয়ে গড়ে ওঠে।

ফলে বাস্তব জীবনের সমস্যা মােকাবেলা করতে তারা ব্যর্থ হয়। এই অসমর্থতা, ব্যর্থতা স্কুল পলায়নের মতাে সমস্যামূলক আচরণ মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয়।

গ. বিপর্যস্ত পরিবার:

দায়িত্বহীন স্বার্থপ্রিয় মা কিংবা অসচ্চরিত্র মদ্যপ বাবা বা বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে ভেঙ্গে যাওয়া সংসার বা সর্বদা মা-বাবার কলহে শান্তিহীন পরিবার প্রভৃতি কারণ শিশুর স্বাভাবিক স্বাস্থ্যময় গৃহ পরিবেশকে নষ্ট করে দিতে পারে ।

এ ধরনের বিপর্যস্ত গৃহে বড় হওয়া শিশুদের মধ্যে সহজেই স্কুল পলায়নতা সহ অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক আচরণের প্রবণতা দেখা যায়।

  • বিদ্যালয় পরিবেশজনিত কারণ:

জীবনের একটা বিরাট অংশ শিশু বিদ্যালয়ে অতিবাহিত করে। বিদ্যালয়ে নিম্নলিখিত কারণে শিশুর মধ্যে স্কুল পলায়নের মতাে বিভিন্ন অপরাধমূলক আচরণ সৃষ্টি হয়।

ক. অনাকর্ষণীয় পাঠ্যক্রম:

শিক্ষার্থীর সামর্থ্য, ক্ষমতা, রুচি ও আগ্রহ অনুযায়ী পাঠ্যক্রম বিন্যস্ত না হলে তা শিশুর চাহিদা মেটাতে পারে না। ফলে সে ক্লাসে বসে থাকার প্রয়ােজনীয়তাও বােধ করে না।

খ. অমনােবৈজ্ঞানিক শিখন পদ্ধতি:

ত্রুটিপূর্ণ শিখন পদ্ধতির ফলে শিক্ষার্থীরা সুষ্ঠু শিক্ষালাভে বঞ্চিত হয়। এই বঞ্চনা তাকে বিভিন্ন অপরাধমূলক আচরণের দিকে নিয়ে যায়।

গ. শিক্ষকের নিপীড়নমূলক আচরণ:

বিশেষ কোন শিক্ষকের হৃদয়হীন নিষ্ঠুর আচরণ শিশুকে ঐ শিক্ষকের প্রতি বিদ্বেষ পরায়ণ করে তােলে। ফলে তারা ঐ বিশেষ শিক্ষকের এবং তিনি যে বিষয়গুলাে পড়ান সেগুলাে এড়িয়ে যেতে থাকে।
স্বাভাবিক ভাবেই ঐ বিষয়ে তারা সাফল্য দেখাতে পারে না।ব্যর্থতার কারণে তারা আরাে বেশি নিপীড়নের শিকার হয় এবং নিপীড়ন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে ক্লাস থেকে পালিয়ে যায়।

ঘ. শিক্ষকের বৈষম্যমূলক আচরণ:

অনেক শিক্ষক আছেন যারা শ্রেণীর সকল শিক্ষার্থীর প্রতি সমান আচরণ করেন না, বিশেষত পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের প্রতি অবজ্ঞাসূচক আচরণ করেন।
শিক্ষকের এ ধরনের আচরণ শিক্ষার্থীদের উদ্যম নষ্ট করে দেয়, তারা পড়াশােনার প্রতি অনাগ্রহী হয়ে ওঠে এবং বিদ্যালয় থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।

ঙ. আদর্শ শ্রেণীকক্ষের অভাব:

শ্রেণীকক্ষ যদি আলােবাতাসপূর্ণ না হয়, শিক্ষার্থীরা যদি আরাম করে বসতে না পারে বা তাদের অঙ্গ সঞ্চালনে অসুবিধা হয় তবে শিক্ষার্থীরা পাঠে মনােনিবেশ করতে পারে না।
তাদের মধ্যে অবসাদ, বিরক্তি ইত্যাদি দেখা যায়। এই অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পেতে তারা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বাইরে সময় কাটাতে চায়।

চ. দলের প্রভাব:

বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের বয়স ও মনমানসিকতা অনুযায়ী দল গঠন করে। দলে অন্তর্ভুক্ত হতে না পারলে বা দল থেকে পরিত্যক্ত হলে তারা নিরাপত্তার অভাব বােধ করে।
একারণে তারা স্কুল পালিয়ে অন্যত্র বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে নিরাপত্তা খোঁজার চেষ্টা করে।

৩. সামাজিক কারণ:

আধুনিক মনােবিজ্ঞানী ও সমাজতত্ত্ববিদেরা স্কুল পলায়ন সহ অন্যান্য কিশাের অপরাধকে একটি সামাজিক সমস্যা বলে বর্ণনা করেন। যে সমাজে নীতিগত আদর্শ সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট বিধি নিষেধ নেই।
সেই সমজে কিশােরদের এ ধরনের আচরণের সাথে সম্পৃক্ত হতে দেখা যায়।

৪. মনােবৈজ্ঞানিক কারণ:

স্কুল পলায়নতা সহ অন্যান্য অপরাধ প্রবণতার একটি বড় কারণ হলাে মনােবৈজ্ঞানিক অপসঙ্গতি।
প্রত্যেক শিশুরই কতকগুলি মৌলিক চাহিদা থাকে, বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে এই চাহিদাগুলাে সংখ্যা ও জটিলতার দিক দিয়ে প্রচুর পরিমাণে বেড়ে ওঠে।
শিশুর এই চাহিদাগুলাে যথাযথভাবে তৃপ্ত না হলে তার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক আচরণ লক্ষ্য করা যায়।
স্কুল পলায়ন যদিও একটি সাধারণ সমস্যামূলক আচরণ, কিন্তু যদি সময়মত এই আচরণ সনাক্ত করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া না হয়, তবে এই সাধারণ সমস্যামূলক আচরণই বড় কোন অপরাধের বীজ হিসেবে অঙ্কুরিত হতে থাকে।
তাই শিশুদের সুষ্ঠু বিকাশের স্বার্থে এসব দিকের প্রতি দৃষ্টি দেয়া পিতামাতা ও শিক্ষকের অবশ্য প্রয়ােজন।
শেয়ার করুন

Similar Posts