শিশুর দৈহিক বিকাশের লক্ষণসমূহ
দৈহিক বিকাশের বিভিন্ন দিক (Sequence of Physical Development):
শিশুর দৈহিক বিকাশের উপর যেসব গবেষণা হয়েছে, সেগুলাে বিশ্লেষণ করলে দৈহিক বিকাশের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে ধারণা লাভ করা যায় । নিচে সেগুলি আলােচনা করা হলাে-
১.দৈহিক উচ্চতার বিকাশ:
জন্মের সময় শিশুর উচ্চতা ১৭” -২০” পর্যন্ত হতে পারে। বয়সবৃদ্ধির সাথে সাথে তার উচ্চতা বাড়তে থাকে। চারমাস বয়সে শিশুর উচ্চতা সাধারণত ২৩”-২৫” এবং এক বছর বয়সে ২৮”-৩০” হয়। জীবনের প্রথম দু’বছর উচ্চতা বৃদ্ধির হার খুব দ্রুত থাকে। এরপর বৃদ্ধি কমতে থাকে এবং ৭ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধির হার আবার কিছুটা বেশি হয়।
আরও দেখুনঃ শিশুর দৈহিক বিকাশ কি? শিশুর দৈহিক বিকাশের বৈশিষ্ট্যসমূহ
এই বয়স পর্যন্ত ছেলে ও মেয়ে উভয়ের উচ্চতা বৃদ্ধির হার একই থাকে। কিন্তু দশ বছর বয়সের পর দেখা যায় মেয়েদের উচ্চতা বৃদ্ধির হার খুব বেড়ে যায় এবং চৌদ্দ বছর পর্যন্ত তা বজায় থাকে। ছেলেদের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত উচ্চতা বৃদ্ধির হার একটু কম দেখা যায়, কিন্তু তার পরেই দ্রুত হারে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়ে।
২.দৈহিক ওজনের বিকাশ:
জন্মের সময় শিশুর ওজন ৬-৮ পাউণ্ড বা তার সামান্য কমবেশি হতে পারে। জন্মের পর প্রথম ৭ দিনে ওজন কমে যায়, কিন্তু এরপর ওজন আবার বাড়তে থাকে। ৬ মাসে শিশুর ওজন জন্ম সময়ের ওজনের দ্বিগুণ এবং এক বছরে তিনগুণ হয়।
পরীক্ষার দ্বারা দেখা গেছে তিন বছর বয়স পর্যন্ত বছরে গড়ে প্রায় পাঁচ পাউণ্ড করে ওজন বাড়ে। তারপর এগার/বার বছর পর্যন্ত ওজন বৃদ্ধির হার খুবই কম থাকে। এর পর আবার হঠাৎ খুব দ্রুত ওজন বাড়তে থাকে। সাধারণভাবে লক্ষ্য করা গেছে ছেলেদের দেহের ওজন মেয়েদের চেয়ে সব সময়ই বেশি থাকে।
৩.দৈহিক কাঠামাের বিকাশ:
বিভিন্ন বয়সে দেহের বিভিন্ন অঙ্গের বিকাশ বিভিন্ন গতিতে হয় এবং প্রায় আঠারাে বছরের মধ্যে এই বিকাশ শেষ হয়। যেমন প্রথমে মাথার বিকাশের কথাই বলা যাক। জন্মপূর্ব বর্ধনে মাথার বৃদ্ধি সর্বোচ্চ হয়। কিন্তু জন্মের পর মাথার বৃদ্ধি কমে আসে।
প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগ বিকাশের কাজ ১২ বছরের মধ্যেই শেষ হয়। এখানেও দেখা গেছে ছেলেদের মাথার আয়তন সব স্তরেই মেয়েদের চেয়ে বড় হয়। জন্মের পর সারা মুখের অবয়বেও পরিবর্তন হয়। জন্মের সময় মুখের যে গােল ভাব থাকে, তা ক্রমে ডিম্বাকৃতি ধারণ করে। কপাল চওড়া হয়, চোয়ালের হাড় বৃদ্ধি পায়, ফলে মুখের অবয়বে কাঠিন্য দেখা দেয়।
আরও দেখুনঃ মানসিক বিকাশ কি? মানসিক বিকাশের বৈশিষ্ট্যসমূহ
জন্মের পর নাকের আকৃতিরও পরিবর্তন হয় এবং তেরাে থেকে চৌদ্দ বছর বয়সের মধ্যে পূর্ণতা লাভ করে । দেহকাণ্ডের পরিবর্তন বিভিন্ন দিক থেকে হয়। জন্মসময়ে দেহকাণ্ডের মধ্যে যে অসামঞ্জস্যতা থাকে; যেমন উপরের অংশ ভারী থাকে, তা ক্রমে বিকশিত হয়ে সাম্যাবস্থার সৃষ্টি হয়।
৪.স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ:
জন্মের পর থেকে শিশুদের স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ খুব দ্রুত গতিতে হয়। যে স্নায়ুকোষ দিয়ে স্নায়ুগুলো গঠিত, তারাও যেমন বিকশিত হয়, তেমনি তাদের সংখ্যাও বাড়ে। সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে মস্তিষ্কের বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ। চার বছর বয়স পর্যন্ত মস্তিষ্ক খুব দ্রুত হারে বাড়ে। এর পর আট বছর বয়সের পর এই হার আবার বাড়ে এবং ষােল বছর বয়সে পরিপূর্ণ বিকাশ হয়।
৫.অস্থিবৎ পেশির বিকাশ:
শিশুর অস্থিতে পানি ও প্রােটিন জাতীয় উপাদান বেশি থাকে বলে শিশুর অস্থি নরম, অনেকটা স্পঞ্জের মতাে হয়। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে অস্থি কেবল লম্বায়ই বাড়ে না, অস্থিৎ পেশির উপাদানেও পরিবর্তন আসে। খনিজ- পদার্থ যেমন- ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের সঞ্চয়নের ফলে ধীরে ধীরে অস্থিবৎ পেশি মজবুত হয়।
৬.মাংসপেশির বিকাশ:
দেহের অস্থি বৃদ্ধির সাথে সাথে মাংসপেশিরও বৃদ্ধি হয়। ৪ বছরের পর শিশুর দেহের বিভিন্ন পেশি সুদৃঢ় হতে থাকে। শৈশব থেকে কৈশােরকাল পর্যন্ত ডােরাকাটা পেশি ও বৃহৎপেশির গঠন চলতে থাকে। ছয় বছর হতে শিশুর পেশি সঞ্চালন নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে এবং ৭/৮ বছর বয়সে শিশু ব্যাট বলের সমন্বয় সাধন করতে সক্ষম হয়। ৮/১০ বছর বয়সের কিশোর-কিশােরীদের চলাফেরায় নিপুণতা লক্ষ্য করা যায়। ক্রমে শিশুর শক্তি সামর্থ্য বাড়ে এবং সে দৈহিক কলাকৌশল আয়ত্ত করে।
৭.যান্ত্রিক/তান্ত্রিক বিকাশ:
জন্মের পর দেহের বাইরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যে শুধু আকারে বাড়ে তাই নয়, দেহের মধ্যকার বিভিন্ন যন্ত্রের বিকাশ হয়। হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের বিকাশ নিজস্ব প্রকৃতিতে হয়। জন্মের পর প্রথম ৬/৭ বছর ছেলেদের হৃদযন্ত্র খুব শক্তিশালী থাকে। ১৩/১৪ বছর বয়সে মূত্রথলি, অন্ত্র, পাকস্থলী, ফুসফুস ইত্যাদির কার্যকারিতা দ্রুত হয় । বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে গ্রন্থিগুলাের ক্রিয়া বাড়তে থাকে এবং এরা অন্যান্য দেহযন্ত্রের বিকাশকে সহায়তা করে।
৮.রােগ-প্রতিরােধ ক্ষমতার বিকাশ:
বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে দেহের রােগ- প্রতিরােধ ক্ষমতার যথেষ্ট উন্নতি হয়। এন্টিবডি যা রােগ প্রতিরােধক ক্ষমতার সর্বোচ্চ বৃদ্ধি সাধন হয় ৬-৭ বছর বয়সে। গলার দু’ধারে অবস্থিত টনসিল ও এডিনয়েড গ্রন্থি জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে বড় হয়ে যায়, ফলে কিছু দৈহিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা এ গ্রন্থি অপসারণের পরামর্শ দেন। এই গ্রন্থির বৃদ্ধি ৭-৮ বছর বয়সের পর থেমে যায় এবং পরবর্তী কালে এদের আকার ছােট হয়ে পড়ে।
আরও দেখুনঃ শারীরিক বৃদ্ধির প্রভাবকসমূহ/বাধা সৃষ্টিকারী উপাদানসমূহ
শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধির সাথে শিশুর আচরণের সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। যেমন- স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশের সাথে সাথে বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি বেড়ে যায়। শিশুর মাংসপেশির বৃদ্ধি ও দৃঢ়তা তাকে নতুন দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে। শিশুর আচরণ তার দৈহিক বিকাশের উপর নির্ভরশীল।
দেহের বিভিন্ন অংশ ও অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপের মধ্যে সমতার ফলেই সুস্থতা আসে। শিশুর ক্ষুধাবৃদ্ধি, কর্মচাঞ্চল্য, উৎসাহ-উদ্দীপনা, দৈহিক ও মানসিক উন্নতিই সুস্থতার লক্ষণ বলে ধরা হয়।