একজন আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকা ও দায়িত্ব

একজন আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকা ও দায়িত্ব

শিক্ষকের ভূমিকা বা কাজ (Role of a teacher):

আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীর স্থান দেয়া হয়েছে সবার অগ্রভাগে। শিক্ষার্থীর প্রয়ােজনকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকল্পনা রচনা করা হয়েছে।
এ অবস্থায় আধুনিক সমাজে শিক্ষকের কাজ অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পূর্ব আহরিত কতকগুলি তথ্য ও নীরস জ্ঞান শিক্ষার্থীকে দান করে আজ আর তার কর্তব্য শেষ হয়।
সে জ্ঞান যাতে শিক্ষার্থী তার বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অর্জন করতে পারে সেটা দেখাই এখন শিক্ষকের প্রধান কাজ।
বিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিমণ্ডলের সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে শিক্ষকের যেসব ভূমিকা পালন করতে হয়, সেগুলােকে দুইভাগে ভাগ করে আলােচনা করা যেতে পারে। যেমন-
ক. শিক্ষাদান কাজে শিক্ষকের ভূমিকা ও
খ. মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে শিক্ষকের ভূমিকা।

ক. শিক্ষাদান কাজে শিক্ষকের ভূমিকা:

বিদ্যালয়ের সাথে শিক্ষকের সম্পর্ক তৈরি হয় শিক্ষাদান সম্পর্কিত কাজের মধ্য দিয়ে। শিক্ষক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করেন।
জ্ঞানের বিবিধ বিষয়াদি যথাযথভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌছানাের জন্য শিক্ষকের পেশাগত কিছু যােগ্যতা অর্জন করতে হয় এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি শিক্ষাদানের কাজটি সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে যেতে পারেন। যেমন:

১. শিক্ষার পরিকল্পনা রচনা করা:

আধুনিক শিক্ষককে দক্ষ পরিকল্পকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচিকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যাতে শিক্ষার্থী সুষ্ঠু জীবনযাত্রার জন্য অর্জনীয় অভিজ্ঞতাগুলাে আহরণ করতে পারে।

২. বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা করা:

আধুনিক শিক্ষক নিজে শিক্ষার্থীকে কোন জ্ঞান দান করেন না, তিনি শিক্ষার্থীকে জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করেন মাত্র।
শিক্ষার্থী যাতে বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে প্রয়ােজনীয় জ্ঞানগুলাে শিখতে পারে এবং আবশ্যক কৌশলগুলাে আয়ত্ত করতে পারে তার ব্যবস্থা, পরিকল্পনা ও সম্পাদনা এসবই বর্তমানে শিক্ষকের কর্মসূচির অন্তর্গত।

৩. গণতন্ত্রমূলক শিক্ষাদান:

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শিক্ষকের দায়িত্ব আরাে বেশি। আজকের শিক্ষার্থী যাতে আগামীকালের রাষ্ট্রের যােগ্য নাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে পারে তার জন্য তাকে প্রস্তুত করার গুরুদায়িত্ব ও আধুনিক শিক্ষকের উপর ন্যস্ত।
গণতান্ত্রিক কার্যাবলির সাথে শিক্ষার্থীর বাস্তব পরিচিতি ঘটানাে এবং গণতান্ত্রিক কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণে সমর্থ করাও শিক্ষকের দায়িত্ব।

৪. জীবন দর্শন গঠন:

শিক্ষার্থীর জীবন দর্শন গঠনে আজ শিক্ষকই হলেন প্রধান। সহায়ক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রাচীন কালের ব্যবধান আজ লােপ পাওয়ায়।
শিক্ষক সরাসরি শিক্ষার্থীর মনের সংগে যােগাযােগ স্থাপন করতে পারেন। শিক্ষার্থী যাতে যুক্তিভিত্তিক পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যময় একটি জীবনদর্শন গড়ে তুলতে পারে, সেদিক দিয়ে আধুনিক শিক্ষকের করণীয় অনেকখানি।
ব্যক্তিগত প্রভাব বিস্তার ও আলােচনার মধ্য দিয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীর মনের গঠনােন্মুখ ভাবধারার একটি সুসংহত রূপ দিতে পারেন।

৫. প্রশাসন সংক্রান্ত কার্যাবলি:

বিদ্যালয় প্রশাসন তথা পরিচালনার দিক দিয়েও আধুনিক শিক্ষকের কাজ কম নয়। বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম নির্ধারণ শ্ৰেণী অনুযায়ী তার বাটন দৈনন্দিন অনুস্মরণীয় কর্মসূচি প্রণয়ন।
শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা ও অগ্রগতির পর্যবেক্ষণ যথাসময়ে তাদের পরীক্ষাগ্রহণ অভিভাবকদের সাথে যােগাযােগ স্থাপন ইত্যাদি বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজের উল্লেখ করা যায় যা আধুনিক শিক্ষকের কর্তব্যের অন্তর্গত।

খ. মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে শিক্ষকের ভূমিকা:

শিক্ষাদানের কাজকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করার জন্য শিক্ষকের পেশাগত বিভিন্ন ভূমিকার সাথে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা করতে হয়।
কোন শিক্ষাদান কার্যক্রমই মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়ােগ ছাড়া সফল হতে পারে না।
মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মূল কথাই হচ্ছে যাকে শিক্ষা দেয়া হবে তার সম্বন্ধে জানতে হবে।
আর এই জানতে গিয়ে শিক্ষক মনােবিদ্যার শরণাপন্ন হবেন। এই দৃষ্টিতে শিক্ষক যেসব ভূমিকা পালন করে থাকেন সেগুলাে হলাে –

১. ব্যক্তিসত্তার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধন:

আধুনিক শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীর জ্ঞানগত উন্নতির সাথে সাথে অন্যান্য দিকের সুষ্ঠু বিকাশ সাধন। শিক্ষার্থীর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আবেগিক প্রভৃতি দিকের বিকাশ সাধনের দায়িত্ব শিক্ষকের ওপর ন্যস্ত।
বিদ্যালয়ে সমাজধর্মী পরিবেশ তৈরি করে শিক্ষার্থীর সামাজিক চেতনাকে পরিপুষ্ট করে তােলা, মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহযােগিতা, বন্ধুপ্রীতি, স্বার্থত্যাগ ইত্যাদি ইতিবাচক গুণাবলি সৃষ্টি করা।
নানা রকম সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলির মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর বিশেষ ক্ষমতাগুলাের বিকাশ করা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি। আধুনিক শিক্ষকের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত।

২। শিক্ষার্থীর গৃহের সাথে যােগাযােগ:

আধুনিক শিক্ষকের কাজ কেবল বিদ্যালয়ের চার দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পাঠাগার, যাদুঘর, খেলার মাঠ থেকে শুরু করে এমনকি শিক্ষার্থীর বাড়ি পর্যন্ত শিক্ষকের গতিবিধি।
বিশেষ করে আজকের শিক্ষককে শিক্ষার্থীর পিতামাতা, ভাইবােনদের সংগে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রাখতে হয়। শিক্ষার্থীর ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য তার সম্পূর্ণ জীবনযাত্রার সঙ্গেই শিক্ষককে পরিচিত হতে হয়।

৩। সুপরিচালনা:

আধুনিক শিক্ষার লক্ষ্য যেহেতু শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন কাজেই শুধুমাত্র বিদ্যালয় পরিমণ্ডলে এই বিকাশকে বজায় রাখলেই চলে।
শিক্ষার্থী যাতে ভবিষ্যতেও এই বিকাশের ধারা বজায় রাখতে পারে এজন্য তাকে যথাযােগ্যভাবে পরিচালনা করাও শিক্ষকের ভূমিকার অন্তর্ভুক্ত।
শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে কোন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবে বা কোন ধরনের পেশার সাথে নিজেকে নিয়ােজিত করবে। সে ব্যাপারে শিক্ষক তাদের নির্দেশনা দিয়ে থাকে।
শিক্ষকের ভূমিকা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক তার পেশাগত ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় করে বিদ্যালয় কর্তৃক তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারেন।
শেয়ার করুন

Similar Posts

0 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *