বাচ্চাদের ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণ ও প্রতিকার
সৃষ্টিকর্তার প্রতিটি সৃষ্টির পিছনে কোন না কোন কারন রয়েছে। আমরা মানুষ জাতি যেমন সৃষ্টির সবচাইতে শ্রেষ্ঠ জীব। প্রতিটি জীবজন্তু কিন্তু আবার বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। ঠিক তেমনি ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া একটি অনেক বড় সমস্যা।
বাচ্চাদের ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে আমরা অনেক সময় উত্তেজিত হয়ে যায়। শুধুমাত্র বাচ্চাদেরই যে ঘন ঘন প্রস্রাব হয় ঠিক তা নয় কিন্তু বাচ্চাদের পাশাপাশি বড়দেরও এই সমস্যা হয়ে থাকে। আমাদের ভেতরে যারা ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যায় ভোগেন, তারা দৈনন্দিন জীবনে নানারকম অসুবিধার সম্মুখীন হন।
এই ধরনের সমস্যায় যারা ভুগেন তারা দিনে এবং রাতে উভয় সময়েই স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি প্রস্রাব করতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার সমস্যাটি ‘পলিইউরিয়া’ নামক মেডিকেল কন্ডিশন থেকে আলাদা। আমাদের শরীরের নিম্ন জনন-মূত্র নালি বা লোয়ার ইউরোজেনিটোল ট্রাক্ট এ কোন ডিজঅর্ডারের কারণে ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আরও পড়ুনঃ দাঁতের মাড়ি ফোলা ও ব্যথা কমানোর উপায়
বাচ্চাদের পাশাপাশি আপনারা যারা প্রাপ্ত বয়স্ক রয়েছেন তাদের মূত্রাশয় অথবা মূত্রনালি বা উভয়েই প্রদাহ হলে ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ আসতে পারে। এই সময় প্রস্রাব করার পরেও অনেকের মনে হতে পারে আরও কিছুটা বাকি রয়েছে এবং প্রস্রাব পুরোটা ক্লিয়ার হয়নি এখনো। তবে এই ক্ষেত্রে প্রস্রাবের পরিমান অনেক কম হয়ে থাকে।
ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণ
আপনার বাচ্চার বা আপনার নিজেরও যদি ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার মতো সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে এটি বিভিন্ন কারনে হতে পারে। তাই চলুন আমরা এই পর্যায়ে জেনে নিবো যে কি কি কারনে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়ে থাকে। যেমনঃ
- কোন কারনে যদি মূত্রাশয়ে সংক্রমণ, রোগ, আঘাত বা জ্বালাপোড়া হয়ে থাকে।
- মূত্রাশয়ের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে এমন পেশি, স্নায়ু বা অন্যান্য টিস্যুতে গাঠনিক বা শারীরবৃত্তীয় কোন পরিবর্তন ঘটলে ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে।
- সুনির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সারের চিকিৎসা
- এমন জাতীয় ওষুধ বা পানীয় রয়েছে যা কিনা আপনার প্রস্রাবের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়।
অনেকেই মনে করেন যে কেনো মার ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার মতো সমস্যা হলো বা কিভাবে হলো সেটি কিভাবে জানতে পারি তাই না? ধরুন আপনি প্রস্রাবজনিত বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন, এতে করে আরও কি কি সমস্যার সম্মুখীন আপনি হতে পারেন বা অনুভব করতে পারেন সেগুলো সম্পর্কে এক নজরে দেখে নেওয়া যাক।
- প্রস্রাবের সময় ব্যথা বা অস্বস্তি
- প্রস্রাব করার প্রবল তাগিদ
- প্রস্রাব করতে অসুবিধা বোধ করা
- মূত্রাশয়ের নিয়ন্ত্রণ হারানো
- প্রস্রাবের অস্বাভাবিক রঙ
কি কি কারণে ঘন ঘন প্রস্রাব হয় বা ঘন ঘন প্রস্রাবের কারণ সমূহ
আমরা এই পর্যায়ে জেনে নিবো যে অন্য কি কারনে আপনার ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার মতো রোগকে প্রভাবিত করে থাকে সেই গুলো সম্পর্কে। নিচে একটি তালিকার দেওয়া হলে যে ঘন ঘন প্রস্রাবের কারণ হিসাবে ভূমিকা রাখতে পারে এমন কিছু সমস্যার নাম সমূহঃ
- সিস্টোসেল – সিস্টোসেল হলো যখন মূত্রাশয় এবং যোনির মধ্যবর্তী প্রাচীর দূর্বল হয়ে যায় তখন এই সমস্যা হতে পারে।
- মূত্রনালিতে সংক্রমণ(ইউটিআই)। মূত্রনালীতে যখন ইনফেকশন হয় এমন সময় ঘন ঘন প্রস্রাবের মতো সমস্যা গুলো দেখা দেয়।
- বিনাইন প্রোস্ট্যাটিক হাইপারপ্লাসিয়া
- মূত্রাশয়ে পাথর হলে প্রস্রাব পুরোটা ক্লিয়ার হয়না এবং ঘন ঘন প্রস্রাবের মতো সমস্যার সৃষ্টি করে এখান থেকে।
- কিডনির কার্যকারিতায় পরিবর্তন অর্থ্যাত কিডনি সঠিক ভাবে তাঁর কার্যকারিতা পরিচালনা করতে ব্যহত হলে তখন এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।
- ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস।
- মূত্রবর্ধক জাতীয় কোন ঔষধ বা খাবার অতিরিক্ত খাওয়া হলে।
- এনজাইটি ডিজঅর্ডার বা উদ্বেগজনিত সমস্যা।
- টাইপ ১ ডায়াবেটিস।
- টাইপ ২ ডায়াবেটিস।
- ইউরেথ্রাল স্ট্রিকচার (মূত্রনালি সরু হয়ে যাওয়া)।
- ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স (প্রস্রাবে অসংযম)।
- পানি, অ্যালকোহল বা ক্যাফেইন এর অতিরিক্ত গ্রহণ।
- ইন্টারস্টিশিয়াল সিস্টাইটিস (পেইনফুল ব্লাডার সিনড্রোম)।
- কিডনি সংক্রমণ – পাইলোনেফ্রাইটিস।
- অতি সক্রিয় মূত্রাশয়।
- গর্ভাবস্থা।
- প্রোস্টেটের সংক্রমণ বা প্রদাহ – প্রোস্টাটাইটিস।
- রেডিয়েশন ট্রিটমেন্ট বা বিকিরণ চিকিৎসা যা শ্রোণি বা তলপেটে প্রভাবিত করে।
- যোনিতে প্রদাহ – ভ্যাজাইনাইটিস ইত্যাদি।
আমরা উপরের আলোচনা থেকে মোটামুটি ধারণা পেয়ছি যে ঘন ঘন প্রসাবের মূল কারণ গুলো কি কি এবং কি কারনে এই সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় সেই গুলো নিয়ে। এখন আমরা আলোচনা করবো যে কি কারনে বাচ্চাদের ঘন ঘন প্রস্রাব হয় এবং এর প্রতিকার কি সেগুলো নিয়ে।
আরও পড়ুনঃ দেহে খাদ্য উপাদানের অভাবের ফলে কি কি রোগ হয়
আমরা জানি যে আমাদের দেশে এক বছরের নিচে বাচ্চাদের বা শিশুদের বিভিন্ন রোগ হয়। এর মধ্যে প্রস্রাবের ইনফেকশন বেশী হয় যা আমরা খেয়াল করি না। এছাড়াও বাবা-মায়ের অবহেলার কারণে এই ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। বিশেষ করে মেয়েদের এ সমস্যাটি বেশী হয়।
প্রতি ১০০ জন মেয়ে শিশুর মধ্যে ৮ জন ও প্রতি জন ছেলে শিশুদের ২ জন প্রস্রাবের ইনফেকশনে ভুগে থাকে। এ সমস্যাটি খুব জটিল থেকে জটিলতর হয়ে থাকে যা কিনা অবহেলা করা হয় এবং যার কারণে শিশুরা দীর্ঘদিন ভুগতে থাকে। অনেক সময় এটা কিডনী ইনফেকশনে রূপান্তরিত হয়। তাই বাচ্চাদের পিতা-মাতার অনেক সর্তক থাকতে হবে।
কিভাবে বুঝবেন প্রস্রাবের ইনফেকশন হয়েছে
- বাচ্চার ঘন ঘন জ্বর জ্বর ভাব থাকবে।
- প্রস্রাব করার সময় বাচ্চা কান্না করবে।
- প্রস্রাবের গন্ধ হবে।
- বাচ্চা প্রস্রাব করতে চাইবে কিন্তু প্রস্রাব হবে না।
- প্রস্রাব হলেও সেটি অনেক কম।
- প্রস্রাব দেখতে গোলাটে হবে।
- বাচ্চার অকারণে বমি হবে।
- কিছুদিন পর পর জ্বর হবে।
- বাচ্চা খেতে চাইবে না।
- ডায়রিয়া মত সমস্যা হবে।
- তলপেটে ব্যথা করবে।
- বাচ্চা রাতে ঘন ঘন বাথরুমে যেতে চাইবে।
আপনার বাচ্চার যদি প্রস্রাবের ইনফেকশন হয়ে থাকে তাহলে উপরের আলোচিত সমস্যা গুলো দেখা দিবে। তাই কখনো যদি এই ধরনের সিন্ট্রোম গুলো আপনার বাচ্চার ভেতরে থেকে থাকে তাহলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
ইনফেকশন হওয়ার কারণ কি কি
আমরা যদি ইনফেকশন এর কারণ সম্পর্কে জানতে চাই তাহলে এটি বলা যায় যে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কিছু স্বাভাবিক শারীরিক কারণে ইনফেকশন হয়ে যায়। তাই সব সময় আপনার বাচ্চাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখতে হবে এবং ইনফেকশন হয় এমন কিছু করা থেকে বিরত রাখতে হবে।
- ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন
- বাচ্চা বাথরুম করার পর যথাযথ ভাবে পরিষ্কার না হওয়া
- কোষ্ঠকাঠিন্য
ঘন ঘন প্রস্রাব বা ইনফেকশন থেকে বাঁচার উপায়
- প্রতিটি বাচ্চাদের সঠিক উপায়ে বাথরুম করার প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
- বাথরুম করার পর ভালোভাবে পরিষ্কার হতে হবে বা পরিষ্কার করে দিতে হবে।
- একদম ছোট বাচ্চা বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের পায়খানা করার পরে পরিষ্কার করার সময় সামনে থেকে পেছনে পরিষ্কার করুন।
- খেয়াল রাখবেন মেয়ে বাচ্চাদের পরিষ্কারের সময় যেন পেছনে থেকে হাত সামনের দিকে না আসে।
- আমাদের মাঝে অনেকেই রয়েছেন বাচ্চাদের দীর্ঘ সময় ডায়াপার পরিয়ে রাখেন। আপনারা সাবধান হয়ে যান এবং দীর্ঘ সময় ডায়াপার পরিয়ে রাখবেন না আপনার শিশুকে।
- বাচ্চার লজ্জাস্থানে হাত দিয়ে আদর করবেন না এবং খোলা রাখবেন না।
- বাচ্চাদের যাতে কোষ্ঠকাঠিন্য না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
- সব সময় বাচ্চাদের খাবারের দিকে খেয়াল রাখবেন এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখবেন।
আরও পড়ুনঃ ভাল স্বাস্থ্যের লক্ষণগুলো জেনে নেই
ঘন ঘন প্রস্রাব দূর করার ঘরোয়া উপায়
অনেকে ঘন ঘন প্রস্রাবের মতো সমস্যায় ভুগছেন কিন্তু লজ্জায় প্রকাশ করতে চান না। তাদের জন্যে আজকে আমরা কিছু ঘরোয়া টিপস শেয়ার করতে চলেছি। আপনার যদি ঘন ঘন প্রস্রাব হবার সমস্যাটি থেকে থাকে এবং এটি দূর করতে চান তাহলে তাঁর জন্য বেশ কিছু ঘরোয়া উপায় রয়েছে।
আপনি চাইলে কিছু ঘরোয়া উপায় গুলো মেনে চলে দেখতে পারেন আশা করছি এতে করে আপনার ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারন ও প্রতিকার দুটোই পেয়ে যাবেন। তাহলে চলুন সেই গুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাকঃ
- রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তরল জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলা।
- মূত্রাশয়ে ইরিটেশন হয়, এমন খাবার ও পানীয় থেকে এড়িয়ে চলা। এদেরকে মেডিকেলীয় ভাষায় ডায়ইউরেটিকস বলে। যেমন:
- কফি বা ক্যাফেইনযুক্ত খাদ্যদ্রব্য
- চা
- অ্যালকোহল
- সোডা
- কিছু সাইট্রাস ফল
- টমেটো ভিত্তিক খাবার
- চকোলেট (সাদা চকলেট নয়)
- কিছু মশলাযুক্ত খাবার ইত্যাদি।
3. প্রতিরক্ষামূলক প্যাড বা অন্তর্বাস পরিধান করা। এটি একটি স্বল্পমেয়াদী সমাধান।
4. ওজন কমানো – অতিরিক্ত ওজন মূত্রাশয়ের উপর চাপ ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব স্থুলকায় রোগীরা তাদের ওজনের দশ শতাংশ কমিয়েছে, তাদের মূত্রাশয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ আগের চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ উন্নত হয়েছে।
ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ হলে যা খাবেন
আপনারা যারা ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যায় ভুগছেন তারা কিছু প্রাকৃতিক উপায়ে বা বিভিন্ন ধরনের ফল, শাকসবজি ইত্যাদি খাবারের তালিকায় রেখে এই ধরনের সমস্যা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেন। তাই ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ হলে আপনারা নিচের দেওয়া তালিকা থেকে খাবার খেতে পারেন।
- ফল
- শাকসবজি
- ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার
- প্রোটিন
- সাপ্লিমেন্ট বা সম্পূরক ও ভেষজ
- এল-আরজিনিন
- পাম্পকিন সীডস বা কুমড়ার বীজ ও বীজের নির্যাস
আরও পড়ুনঃ কালোজিরার উপকারীতা ও গুণাগুণ
শেষকথাঃ বাচ্চাদের ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণ ও প্রতিকার
আপনারা যারা আমাদের আজকের এই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ মনযোগ সহকারে পড়েছেন আশা করি আপনারা বাচ্চাদের ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণ ও প্রতিকার করার উপায় সম্পর্কে জেনে গিয়েছেন। উপরের দেওয়া নির্দেশনা বলি গুলো যদি মেনে চলেন তাহলে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারেন।
আপনারা চাইলে আমাদের ওয়েবসাইটের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ এবং টুইটারে লাইক কমেন্ট করে সাথেই থাকুন। এতে করে নতুন নতুন পোস্ট পাবলিশের সাথে সাথে নটিফিকেশন পেয়ে যাবেন। এছাড়াও আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে তাদেরও জানারা সুযোগ করে দিতে পারেন।